গুণগত রসায়ন এই অধ্যায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্রে । লেকচার শীটটি এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যাতে অন্তর্ভুক্ত আছে বহুনির্বাচনি ও সৃজনশীল প্রশ্নোত্তর , ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি , মেডিকেল প্রস্তুতি , ইন্জিনিয়ারিং প্রস্তুতি এই নোটটি পড়লে আর কোথাও কোচিং করতে হবে না ।
পরমাণু পরিচিতি
পরমাণু (Atom) হলো রাসায়নিক উপাদানের ক্ষুদ্রতম কণা যা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে এবং উপাদানের বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। প্রতিটি পদার্থ পরমাণু দিয়ে গঠিত, এবং এটি অদৃশ্য ও অবিভাজ্য বলে একসময় ধারণা করা হতো। তবে আধুনিক রসায়নে জানা যায় যে পরমাণু আরও ক্ষুদ্র কণিকা দিয়ে গঠিত।
মূল কণিকা
পরমাণু তিনটি প্রধান উপাদান বা মূল কণিকা নিয়ে গঠিত:
প্রোটন (Proton)
- চার্জ: ধনাত্মক (+1)
- ভর: প্রায় $1.6726 \times 10^{-27}$ কিলোগ্রাম
- অবস্থান: পরমাণুর কেন্দ্রে বা নিউক্লিয়াসে
- বৈশিষ্ট্য: প্রোটনের সংখ্যা উপাদানের আণবিক সংখ্যা নির্ধারণ করে।
নিউট্রন (Neutron)
- চার্জ: কোনো বৈদ্যুতিক চার্জ নেই (নিরপেক্ষ)
- ভর: প্রায় $1.6749 \times 10^{-27}$ কিলোগ্রাম (প্রোটনের সাথে প্রায় সমান)
- অবস্থান: নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সাথে
- বৈশিষ্ট্য: নিউট্রনের সংখ্যা ভর সংখ্যা নির্ধারণে সহায়তা করে।
ইলেকট্রন (Electron)
- চার্জ: ঋণাত্মক (-1)
- ভর: প্রায় $9.1094 \times 10^{-31}$ কিলোগ্রাম (প্রোটনের তুলনায় খুবই কম)
- অবস্থান: নিউক্লিয়াসের চারপাশে নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে বা অরবিটালে
- বৈশিষ্ট্য: রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ইলেকট্রনের বিন্যাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পরমাণুর মডেল : গুণগত রসায়ন
পরমাণুর গঠন ও আচরণ বোঝার জন্য বিভিন্ন বিজ্ঞানী বিভিন্ন মডেল প্রস্তাব করেছেন। নিচে প্রধান পরমাণু মডেলগুলো আলোচনা করা হলো:
ডাল্টনের পরমাণু তত্ত্ব (John Dalton, 1808)
মূল ধারণা:
- পরমাণু হলো অদৃশ্য ও অবিভাজ্য কণিকা।
- একই উপাদানের সব পরমাণুর ভর ও বৈশিষ্ট্য একই।
- বিভিন্ন উপাদানের পরমাণুর ভর ও বৈশিষ্ট্য ভিন্ন।
- রাসায়নিক যৌগগুলো নির্দিষ্ট অনুপাতে পরমাণুর সংমিশ্রণ।
থমসনের প্লাম পুডিং মডেল (J.J. Thomson, 1904)
মূল ধারণা:
- পরমাণু একটি ধনাত্মক চার্জযুক্ত গোলকের মতো যেখানে ঋণাত্মক ইলেকট্রনগুলো ছড়িয়ে আছে।
- ইলেকট্রন ও ধনাত্মক চার্জের সমন্বয়ে পরমাণু নিরপেক্ষ হয়।
রাদারফোর্ডের নিউক্লিয়ার মডেল (Ernest Rutherford, 1911)
সোনার পাত পরীক্ষা:
- আলফা কণিকা সোনার পাতের মাধ্যমে পাঠানো হয়।
- বেশিরভাগ কণিকা সরাসরি চলে যায়, কিছু বিকৃত হয়, এবং খুব কম কণিকা ফিরে প্রতিফলিত হয়।
মূল ধারণা:
- পরমাণুর কেন্দ্রে ক্ষুদ্র, ঘন, ধনাত্মক চার্জযুক্ত নিউক্লিয়াস রয়েছে।
- ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘূর্ণায়মান।
সমস্যা:
- ইলেকট্রনগুলো ক্রমাগত শক্তি হারিয়ে নিউক্লিয়াসে পতিত হওয়া উচিত, যা বাস্তবে ঘটে না।
বোরের মডেল (Niels Bohr, 1913)
মূল ধারণা:
- ইলেকট্রনগুলো নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে বা অরবিটে ঘূর্ণায়মান।
- ইলেকট্রন এক স্তর থেকে অন্য স্তরে যেতে নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি শোষণ বা নির্গত করে।
- পরমাণুর স্পেকট্রাল লাইনগুলো এই মডেল দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়।
সীমাবদ্ধতা:
- শুধুমাত্র একই ইলেকট্রনযুক্ত পরমাণু (যেমন হাইড্রোজেন) জন্য কার্যকর।
কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল মডেল
বিজ্ঞানী: এরউইন শ্রোডিঙ্গার, ভার্নার হেইজেনবার্গ প্রমুখ।
মূল ধারণা:
- ইলেকট্রনের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা যায় না (হেইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি)।
- ইলেকট্রনের অবস্থান সম্ভাব্যতা দ্বারা বর্ণিত হয়।
- অরবিটালের ধারণা আসে, যা ইলেকট্রনের অবস্থানের সম্ভাব্য স্থান।
বৈশিষ্ট্য:
- পরমাণুর জটিল গঠন ও ইলেকট্রনের আচরণ ব্যাখ্যা করতে সক্ষম।
গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা : গুণগত রসায়ন
আণবিক সংখ্যা (Atomic Number, Z):
- নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা।
- উপাদানের পরিচয় নির্ধারণ করে।
ভর সংখ্যা (Mass Number, A):
- নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা।
- A = Z + N (N = নিউট্রনের সংখ্যা)।
আইসোটোপ:
- একই আণবিক সংখ্যার কিন্তু ভিন্ন ভর সংখ্যার পরমাণু।
- উদাহরণ: হাইড্রোজেনের তিনটি আইসোটোপ—প্রোটিয়াম, ডিউটেরিয়াম, ট্রিটিয়াম।
আইসোবার:
- ভর সংখ্যা একই কিন্তু আণবিক সংখ্যা ভিন্ন।
আইসোটোন:
নিউট্রনের সংখ্যা একই কিন্তু প্রোটনের সংখ্যা ভিন্ন।
কোয়ান্টাম সংখ্যা (Quantum Numbers)
ইলেকট্রনের অবস্থান, শক্তি এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার জন্য ব্যবহৃত সংখ্যাগুলোর একটি সেট। প্রতিটি ইলেকট্রনকে চারটি কোয়ান্টাম সংখ্যা দিয়ে বর্ণনা করা হয়, যা নির্দিষ্ট অরবিটালে ইলেকট্রনের শক্তি, গতি এবং দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করে।
কোয়ান্টাম সংখ্যার ধরন
প্রধান কোয়ান্টাম সংখ্যা (Principal Quantum Number, n )
- সংকেত: n
- অর্থ: এটি ইলেকট্রনের শক্তিস্তরের (শেল) নির্দেশ করে।
- মান: n এর মান ১, ২, ৩… এমনকি যে কোনো ধনাত্মক পূর্ণসংখ্যা হতে পারে।
বৈশিষ্ট্য:
- n এর মান যত বড় হবে, ইলেকট্রনের শক্তি এবং নিউক্লিয়াস থেকে দূরত্ব তত বেশি হবে।
- উদাহরণ: n =1 হলে K শেল, n=2 হলে L শেল ইত্যাদি।
কক্ষীয় কোয়ান্টাম সংখ্যা (Azimuthal Quantum Number, l )
- সংকেত: l
- অর্থ: এটি শক্তিস্তরের উপস্তর বা অরবিটালের আকৃতি নির্দেশ করে।
- মান: l এর মান ০ থেকে n – 1 পর্যন্ত হতে পারে।
বৈশিষ্ট্য:
- l = 0 হলে s-অরবিটাল (গোলাকার আকৃতি),
- l = 1 হলে p-অরবিটাল (ডাম্ববেল আকৃতি),
- l = 2 হলে d-অরবিটাল, এবং
- l = 3 হলে f-অরবিটাল।
চুম্বকীয় কোয়ান্টাম সংখ্যা (Magnetic Quantum Number, ml )
- সংকেত: m_l
- অর্থ: এটি ইলেকট্রনের অরবিটালের দিক নির্দেশনা বা অরবিটালের অভিমুখ নির্দেশ করে।
- মান: m_l এর মান -l থেকে +l পর্যন্ত পূর্ণসংখ্যা হতে পারে।
বৈশিষ্ট্য:
- প্রতিটি উপস্তরের মধ্যে বিভিন্ন অরবিটালের অভিমুখ নির্ধারণ করে।
- উদাহরণ: l = 1 হলে m_l = -1, 0, +1 ইত্যাদি।
স্পিন কোয়ান্টাম সংখ্যা (Spin Quantum Number, m_s )
- সংকেত: m_s
- অর্থ: এটি ইলেকট্রনের ঘূর্ণন (স্পিন) নির্দেশ করে।
- মান: m_s এর মান +1/2 বা -1/2 হতে পারে।
বৈশিষ্ট্য:
- ইলেকট্রন নিজ অক্ষের চারপাশে দুই ধরনের ঘূর্ণন করে, এক্ষেত্রে m_s এর মান +1/2 থাকলে “clockwise” এবং -1/2 থাকলে “anticlockwise” নির্দেশ করে।
কোয়ান্টাম সংখ্যার গুরুত্ব
- কোয়ান্টাম সংখ্যা দ্বারা ইলেকট্রনের অবস্থান, শক্তি, এবং অরবিটালের গঠন সম্পূর্ণরূপে নির্ধারণ করা যায়।
- ইলেকট্রনের বৈশিষ্ট্য যেমন আণবিক বন্ধন এবং রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ার ধরন ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে।
- ইলেকট্রন কনফিগারেশন নির্ধারণে কোয়ান্টাম সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এই কোয়ান্টাম সংখ্যা গুলি গুণগত রসায়ন (Qualitative Chemistry) এর ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলি ইলেকট্রনের গুণগত বৈশিষ্ট্য এবং কেমিক্যাল বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে সাহায্য করে।
ইলেকট্রন বিন্যাস (Electron Configuration)
কোনো পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো কীভাবে বিভিন্ন শক্তিস্তর বা অরবিটালে বিন্যস্ত থাকে, তার একটি ব্যাখ্যা। ইলেকট্রনগুলো নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বিভিন্ন শেলে এবং উপস্তরে অবস্থান করে। ইলেকট্রন বিন্যাস বোঝার মাধ্যমে আমরা পরমাণুর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য, আণবিক বন্ধন এবং প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা করতে পারি।
আরো পড়ুন :
এইচএসসি রসায়ন ল্যাবরেটরির নিরাপদ ব্যবহার নোট
ইলেকট্রন বিন্যাসের নিয়ম
ইলেকট্রন বিন্যাস নির্ধারণের জন্য কিছু নিয়ম বা নীতি অনুসরণ করতে হয়:
১. আউফবাউ নীতি (Aufbau Principle)
- ইলেকট্রনগুলো সর্বনিম্ন শক্তির অরবিটাল থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে উচ্চতর শক্তির অরবিটালে বিন্যস্ত হয়।
- অরবিটালের শক্তির ক্রম হলো: 1s < 2s < 2p < 3s < 3p < 4s < 3d < 4p < 5s < 4d < 5p
২. পাউলি বর্জন নীতি (Pauli Exclusion Principle)
- কোনো নির্দিষ্ট অরবিটালে সর্বোচ্চ দুটি ইলেকট্রন থাকতে পারে এবং তাদের স্পিন বিপরীত হতে হবে।
- এক অরবিটালে যদি একটি ইলেকট্রন থাকে, সেটি +1/2 স্পিনযুক্ত হলে অন্যটি -1/2 স্পিনযুক্ত হবে।
৩. হান্ডের নীতি (Hund’s Rule)
- ইলেকট্রনগুলো একই শক্তির অরবিটালে (যেমন, p, d বা f) সর্বাধিক সংখ্যক ইলেকট্রন এককভাবে অবস্থান করে এবং তারপর তাদের জোড়া হয়।
- অর্থাৎ, ইলেকট্রন প্রথমে এককভাবে প্রবেশ করে এবং তারপর অরবিটালে জোড়া হয়।
ইলেকট্রন বিন্যাসের উদাহরণ
হাইড্রোজেন (H):
- আণবিক সংখ্যা ১
- ইলেকট্রন বিন্যাস: 1s^1
- হাইড্রোজেনের একটি ইলেকট্রন আছে এবং এটি ১ম শক্তিস্তরের s-অরবিটালে অবস্থান করে।
হিলিয়াম (He):
- আণবিক সংখ্যা ২
- ইলেকট্রন বিন্যাস: 1s^2
- হিলিয়ামের দুটি ইলেকট্রন 1s-অরবিটালে জোড়া অবস্থায় থাকে।
কার্বন (C):
- আণবিক সংখ্যা ৬
- ইলেকট্রন বিন্যাস: 1s^2 2s^2 2p^2
- কার্বনের ছয়টি ইলেকট্রনের মধ্যে দুটি 1s-অরবিটালে, দুটি 2s-অরবিটালে, এবং দুটি 2p-অরবিটালে বিন্যস্ত থাকে।
নিয়ন (Ne):
- আণবিক সংখ্যা ১০
- ইলেকট্রন বিন্যাস: 1s^2 2s^2 2p^6
- নিয়নের সমস্ত ইলেকট্রন প্রথম দুটি শেলে সম্পূর্ণভাবে পূর্ণ থাকে। এটি একটি সম্পূর্ণ পূর্ণ শক্তিস্তরযুক্ত অস্থিতিশীল গ্যাস।
এইচএসসি রসায়ন ১ম পত্র ‘গুণগত রসায়ন ‘ এর লেকচার শীটটি ডাউনলোড করুন :